সোমবার, ৭ জুলাই ২০২৫, ২৩ আষাঢ় ১৪৩২
সোমবার, ৭ জুলাই ২০২৫, ২৩ আষাঢ় ১৪৩২

কামরূপ কামাখ্যা মন্দির ঐতিহাসিক তীর্থস্থান

অধ্যাপক ডাক্তার চিত্তরঞ্জন শর্মা: বিশ্ব এটার যজ্ঞ উপলক্ষ্যে বিরাট ব্যাপার। বিশ্বের প্রায় সকল দেবগণ, মুনিগণ ও ঋষিদের উপস্থিতিতে যজ্ঞস্থল কানায় কানায় পূর্ণ। রাজা দক্ষ এমন সময় উপস্থিত হলেন। তাঁকে অভিবাদন করলেন দেবগন, মুনিগণ ও অরিগন সকলেই দাঁড়িয়ে সংবর্ধনা জানালেন। কেবল দাঁড়ালেন না ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব। দক্ষ ভাবলেন ব্রহ্মা তার পিতৃ দেন ও বিষ্ণু ব্রিজতের শাসনকর্তা উনারা না দাঁড়িয়ে ঠিকই করেছেন। কিন্তু শিব দাঁড়ালো না কেন? শিব হলো আমায় কন্যার স্বামী। নিজেকে অপমানিত মনে করে শিবকে নিন্দা করতে লাগলেন। কিন্তু তাতেও দুঃখ দূর না হওয়ায় প্রজাপতি দক্ষ বিরাট যজ্ঞের আয়োজন করলেন।

ত্রিভুবনের সকলেই নিমন্ত্রিত হল কিন্তু শিব ও কন্যা সতীর নিমন্ত্রণ হলো না। বাশের বাড়ির যজ্ঞের কথা শুনে সতী যজ্ঞের স্থানে যেতে ইচ্ছে প্রকাশ করেন। শিবের নিষেধ সত্ত্বেও সতী ধাপের বাড়িতে যেতে প্রথমে দুঃখিত হয়ে কাঁদতে লাগলেন। পরে সতীর ভয়ানক ক্রোধমূর্তি দেখে দেবাদিদেব শিব দিশেহারা ও শুব্ধ হয়ে অনুমতি দেন। শিব বললেন আমি দশ মহাবিদ্যার রূপ দেখলাম। হে দেবী তুমি জগদ্ধাত্রী। আদ্যাশক্তি মহামায়া। দেবী বললেন আমি তোমার প্রিয়তমা পত্নী, তুমি আমার প্রিয় প্রতি। আমি পিতা দক্ষের যজ্ঞ ধ্বংস নিমিত্তে অতিসত্বর সেখানে যাব। তুমি যেখানে না যাও তোমার আজ্ঞা নিয়ে আমি যাচ্ছি। আমাকে ক্ষমা করো।

সতী যজ্ঞের স্থানে উপস্থিত হয়ে মহাযজ্ঞ ধ্বংস করেন এবং নিজের দেহ আত্মাহুতি দেন। দেবাদিদেব শিব এই মর্মান্তিক কথা শুনে পাগলের মত সতীর দেহ নিয়ে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতে থাকেন। বিষ্ণু এহেন অবস্থা দেখে তাঁর সুদর্শন চক্র দ্বারা সতীর দেহ ৫১টি ভাগে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দেন। ৫১ টি দেহস্থানে মহাতীর্থ স্থানে পরিণত হয়েছে। বর্তমানেও যথারীতি পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কামরূপ কামাখ্যা তীর্থে সতীর দেহের গুরুত্বপূর্ণ অংশ পতিত হয়েছে। কামরূপ কামাখ্যা তন্ত্রপীঠ নামে বিখ্যাত।

গুপ্ত সাধনায় রত হন তান্ত্রিকরা। জানা মতে মন্দির অঞ্চলে এমন জায়গা রয়েছে যেখানে কোন পুরুষ গেলে আর ফিরে আসতে সক্ষম হয় না। যৌবনবতী নারীদের রাজত্ব। এখানে তারা পুরুষদেরকে যাদু মন্ত্র দ্বারা তাদের ক্রীতদাস করে রাখে। মোহিনী বিদ্যা, যাদুবিদ্যা ও ডাকিনী বিদ্যাসহ একাধিক গুপ্ত সাধনার মহাপীঠস্থান এই মন্দির। পূর্ব ভারতের আসামে অবস্থিত এই মন্দির। গুয়াহাটি শহরের প্রাকৃতিক দৃশ্য অতি মনোরম। প্রায় তিন কিলোমিটার পাহাড়ের উপরে এই মন্দিরটির অবস্থান। নিলাচল পাহাড় বনাঞ্চলের দৃশ্য ও লোকালয় গুলো খুব সুন্দর।

ব্যবসায়ীরা দোকানে ফুল, ফল, নৈবেদ্য ও কামরূপ-কামাখ্যার মূর্তি বিক্রি করেন। মন্দিরে খালি পায়ে প্রবেশ করতেই হবে। দর্শণার্থীরা সকাল থেকে সারিবদ্ধভাবে মন্দিরে প্রবেশ করেন। মন্দিরে দেব-দেবীদের নানা মূর্তি ও কারুকার্য মন মাতানো। শিব পার্বতীর ভালবাসার চিত্র এখানে দেখার মত। অসংখ্য কবুতরের বিচরণ দর্শনার্থীকে আনন্দ দেয়। মন্দিরের পূজারী ও প্রায় পূণ্যার্থীরা গেরুয়া বস্ত্র পড়েন। প্রায় নারীরা লাল শাড়ি পড়ে আসেন।

জনশ্রুতি আছে দেবীর ঋতুস্রাবের সময় প্রতিমার চারপাশে সাদা কাপড় বিছিয়ে দেওয়া হয়। তিন দিন পর মন্দিরের দরজা খুললে মায়ের রক্তমাখা সেই সাদা কাপড় লাল হয়ে যায়। সেইখান থেকেই লাল কাপড় পরার রীতি। ধুপ, মোমবাতি, রক্ত জবা ও প্রদীপের গন্ধে মন্দিরের দৃশ্য এক অপূর্ব ভিন্ন জগৎ। গর্ভগৃহ এবং চলন্ত পঞ্চরথ ও নাট মন্দির।

উল্লেখযোগ্য যে, মন্দিরের গর্ভগৃহ পঞ্চরথ স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত। এটি ভূগর্ভস্থ একটি গুহ্য। ক্ষুদ্র এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন গুহায় সরু খাড়া সিঁড়ি দিয়ে প্রবেশ করার সময় দর্শনার্থীদের অন্যরকম অনুভূতি হয়ে থাকে। সেখানে কোন প্রতিমা দেখা যাবে না। ঢালু পাথরের একটি খন্ড আছে যোনি আকৃতির। পূজারীদের মতে এটি ১০ ইঞ্চি গভীর গর্ত। ভূগর্ভস্থ প্রস্রবনের পানি বেরিয়ে গর্ত সব সময় ভর্তি থাকে। এই বিশালাকার শিলাখণ্ডটি কামাক্ষা নামে বহু যুগ পূর্ব হতে পূজা হয়ে আসছে। যা দেবীর পীঠস্থান হিসেবে প্রসিদ্ধ। বাংলাদেশস্থ চট্টগ্রাম দেওয়ানজী পুকুর লেইনেও যথারীতি কামাক্ষা দেবীর পূজা চলে। তৎকালীন গৌড়ে রাজা কালাপাহাড় ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে সমস্ত অঞ্চল ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে কোচ রাজবংশের রাজা বিশ্বসিংহ কামরূপ প্রদেশ দখল করেন। তিনি ধ্বংস হয়ে যাওয়া কামাক্ষার মন্দিরের অস্তিত্ব খুঁজে পান। তাঁর দুই পুত্র নারায়ণ ও চিলারায়। এই মন্দির ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে কোচ রাজারা তৈরি করেন।

ঐতিহাসিক ধর্মীয় শাস্ত্রমতে বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র থেকে বিচ্ছিন্ন সতীর যোনি অংশটি এখানে মাটিতে পড়েছিল। এই কারণেই একে কাম্য ক্ষেত্র কামরূপ কামাখ্যা বলা হয়ে থাকে। জয় কামরূপ কামাখ্যা দেবীঃ

লেখক- চিকিৎসক ও প্রাবন্ধিক।