সোমবার, ৭ জুলাই ২০২৫, ২৩ আষাঢ় ১৪৩২
সোমবার, ৭ জুলাই ২০২৫, ২৩ আষাঢ় ১৪৩২

শ্রী জগন্নাথ দেব, মন্দির ও রথযাত্রা মাহাত্ম্য

ডাঃ চিত্ত রঞ্জন শর্মা

কলি যুগে শ্রী জগন্নাথ সাক্ষাৎ সচল বিগ্রহ। যাঁহার পূজা, সেবা ও দর্শন করলে মানব জন্ম সার্থক হয়, পরম মুক্তি লাভ হয়। নিম কাঠের দ্বারা তৈরি বিগ্রহ হলেও তিনি জীবিত। কুরুক্ষেত্র ধর্ম যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর শ্রী জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা দ্বারকায় যাবার প্রস্তুত হলেন, তখন মা শ্রীমতি রোহিনী দেবী ও দ্বারকায় যাবার আগ্রহ প্রকাশ করেন। দ্বারকায় যাবার পথে রথে মাকে বলেন তিনি যেন দ্বারকার কাহারও সঙ্গে বৃন্দাবনের মাধুর্য্য রসের কথা এবং রাধাকৃষ্ণের প্রেমের মাধুর্য্য রসের কথা না বলেন। ধর্মগ্রন্থের বর্ণনা অনুসারে ঘোল সহস্র আট জন গোপিনী রোহিনী দেবী কে বলেন আমরা সকলে মিলে প্রাণ বল্লভ শ্রীকৃষ্ণের সেবা করি। তারপরও তিনি ঘুমের ঘোরে বলে ওঠেন কোথায় বৃন্দাবন কোথায় প্রেমময়ী রাধা। গোপিনীরা রোহিণী দেবীকে বিনীতভাবে বৃন্দাবনের সমস্ত প্রেমের কথা খুলে বলতে প্রার্থনা করলেন চারিদিকে গোপিগন ও দরজায় সুভদ্রা কে প্রহরী রেখে রোহিনি দেবী বৃন্দাবনের তরুলতা, পশুপাখি ও শ্রীমতি রাধারানীর আত্মনাদের কথা বলতে বলতে সুভদ্রা অচেতন হয়ে পড়েন। শ্রী জগন্নাথ ও বলরাম সেখানে উপস্থিত হলে সুভদ্রা দেবীর মতো শ্রী জগন্নাথ ও বলরামও বিগলিত তনু হয়ে গেলেন। ভাগ্যক্রমে নারদ মুনি সেখানে উপস্থিত হয়ে তাঁর বীণার শব্দে দেহের পূর্বের অবস্থাপ্রাপ্ত হলেন। শ্রী জগন্নাথ রোহিনীকে কৃষ্ণ কথা বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করেন। নারদ মুনি শ্রী জগন্নাথকে প্রার্থনার সহিত বললেন ইতিমধ্যে আপনাদের দেহের যে রূপ দেখেছি সে রূপ যেন কলিযুগের সবাই দর্শন করতে পারে। শ্রী জগন্নাথ বলেন তোমার মনোবাসনা কলিযুগে পূর্ণ হবে এবং সবাই দর্শন করে ধন্য হবে। হিন্দু ধর্মের আরেকটি মতবাদ আছে ত্রেতাযুগে শ্রীরাম বালিকে বধ করে ছিলেন। বালির পুত্র অঙ্গদ ও শ্রীরামকে বধ করবে বলে জানিয়েছিলেন। তখন শ্রীরাম অঙ্গদকে বলেছিলেন দ্বাপর যুগে তার মনোবাসনা পূর্ণ হবে। সত্যই দ্বাপর যুগে অঙ্গদ জারা নামক ব্যাধ রূপে জন্মগ্রহণ করেন এবং শ্রীরামকে রাম পায়ে তীর মেরে হত্যা করেন। শ্রীরামের দেহ সৎকার নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল, ধীবর ও পান্ডবদের মধ্যে। শেষ সিদ্ধান্ত হয়েছিল ধীবর শবরেরা দেহ সৎকার করবেন আর ক্ষত্রিয়রা ক্রিয়া করবেন।

যারা শ্রীরামকে বলে ছিলেন আমি আপনার হত্যাকারী হিসেবে জগতে প্রচারিত থাকবে। এই অভিশাপ থেকে মুক্ত হব কেমন করে? কলি যুগে তোমার নাম হবে বিশ্ব বসু এবং তোমার হাতেই জগন্নাথ রূপে সেবা গ্রহণ করব। সৎকারের সময় অগ্নি কোনক্রমেই শ্রী জগন্নাথের দেহ স্পর্শ করতে পারছিল না। ভগবানের হৃদয় পিঞ্জরটি সাগরে ফেলে দেয়া হয়েছিল। যারা শবর খুবই অনুতপ্ত হয়ে সমুদ্রের তীর বরাবর জগন্নাথের গতি অনুসরণ করে ওড়িশার পুরীতে পৌঁছায় এবং সমুদ্র তীর থেকে সেটি সংগ্রহ করে জঙ্গলের মধ্যে পূজা করতে থাকেন। বহুযোগ অতিক্রম হওয়ার পর সেটি নিল পাথরে রূপান্তরিত হয়। উহাই নীল মাধব রূপে আখ্যায়িত হয়েছে। কয়েক শতাব্দীর পর মালবরাজ ইন্দ্রদ্যুন্ন বিষ্ণুপূজা প্রবর্তনের ইচ্ছা করায় একদিন স্বপ্নে দেখলেন নীল মাধবকে। নারদ মুনিই রাজাকে নীল মাধব উপাসনার কথা বলেন। চতুর্দিকে দূত পাঠানো হলো। বিদ্যাপতিকে পূর্বাঞ্চলের অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হয়। বিদ্যাপতি পূর্ব সমুদ্র তীর ভূমির জঙ্গলের মধ্যে শরব সর্দার বিশ্ব বসুর গৃহে আশ্রয় গ্রহণ করেন। বিশ্ববসু জঙ্গলে পূজা করার কারণ জেনে নেন। বিশ্ব বসুর কন্যা ললিতাকে বিবাহ করেন। নীলমাধব দর্শন করার জন্য অনুরোধ জানান। বিদ্যাপতির চক্ষু বন্ধ করে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। সকল কিছু অবগত হয়ে তিনি রাজা ইন্দ্রদ্যুন্নকে জানান। রাজা ইন্দ্রদ্যুন্ন নীল অনুসন্ধানে গিয়ে সন্ধান না পেয়ে দুঃখিত হয়েও অনুতপ্ত হন। নীলমাধব স্বপ্নে ইন্দ্রদ্যুন্নকে জানালেন বিশ্ব বসুকে ছেড়ে দিতে ও নীলাদ্রির উপরে একটি মন্দির নির্মাণ করতে, নীলমাধব পরদিন সকালে সমুদ্রে বান্ধিমুত্থান (চক্রতীথের নিকট) নামক স্থানে দারু ব্রহ্মরূপে ভাসতে ভাসতে উপস্থিত হবেন বলে জানালেন। তারপর স্বপ্নে নির্দেশিত স্থানে গিয়ে রাজা, সৈন্য সামন্ত, হস্তিবল দারু ব্রহ্মাকে সমুদ্র তীরে উঠাতে পারলেন না। পরবর্তীতে রাজা স্বপ্নে আদেশ পেয়ে বিশ্ব বসু ও বিদ্যাপতিকে দারু ব্রহ্মকে উঠাতে অনুরোধ করেন। তাদের হত স্পর্শে দারুব্রহ্মটি অনায়াসে তীর ভূমিতে তুলে আনা সম্ভব হল। এবার মূর্তি গঠনের পালা দারুব্রহ্মটিকে শ্রীমূর্তি রূপে প্রকট করার প্রত্যয়ে ইন্দ্রদ্যুন্ন বহু প্রখ্যাত শিল্পীকে আহ্বান করেছিলেন কিন্তু সকলে হতাশ হয়েছেন। অবশেষে বিশ্বকর্মা অনন্ত মহারান নামে একজন বৃদ্ধ শিকারীর বেশে উপস্থিত হয়ে ২১ দিনের মধ্যে মূর্তি তৈরি করে দিতে আশ্বাস দেন। বিশেষ শর্ত হলো ২১ দিন মন্দিরের দরজা বন্ধ থাকবে। কেউই প্রবেশ করতে পারবে না। রাজা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলে বৃদ্ধ সূত্রধর মূর্তি তৈরীর কাজে লিপ্ত হন। মন্দিরাভ্যন্তর থেকে কোন সাড়া শব্দ না পাওয়ায় ১৫ দিন পর রানী গুন্ডিকা চিন্তিত হয়ে পড়েন। রানী মনে করেছিলেন বদ্ধ ঘরে শিল্পী হয়তো প্রান ত্যাগ করেছেন। বিদ্যাপতি ও মন্ত্রীর বাধা উপেক্ষা করে গুন্ডিকা রানীকে সান্তনা দেবার জন্য রাজা ইন্দ্রদ্যুন্ন দরজা খুলে ফেলেন। কিন্তু হায় সূত্রধরকে পাওয়া গেল না প্রতিটি বিকলাঙ্গ ও অসম্পূর্ণ। বর্তমান বিশ্বের সর্বত্র ঐরূপ মূর্তিতে পূজা হচ্ছে। উল্লেখ্য যে, ত্রেতা যুগে নারদ মুনি অবিকল সেই রূপেই কলিযুগে দর্শন করতে প্রার্থনা করেছিলেন। রাজা ইন্দ্রদ্যুন্ন প্রতিজ্ঞা পালনে ত্রুটির জন্য অনুশোচনা করতে থাকেন। তিনি নিজেকে অপরাধী সাব্যস্ত করে আহার নিদ্রা ত্যাগপূর্বক প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার চিন্তায় মগ্ন ছিলেন। রাজা ইন্দ্রদ্যুন্নকে জগন্নাথ স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন কলিযুগে তিনি ঐরূপ ধারণ করে থাকতে চান। তিনি আরো বলেন আমার হাত, পা অবয়ব দৃশ্য না হলেও অনুরাগী বৃন্দের পূজা, বন্দনা ও সেবা ইত্যাদি গ্রহণ করব। বিশ্ব বসুর বংশধর ও বিদ্যাপতির বংশধরদের মন্দিরের কাজে নিয়োগ করতে হবে। আরেকটি মতবাদ রয়েছে দ্বারকায় প্রভাসে যারা দেহ দাহ করেছিল তারা ভোগরান্ন করবে। আর যারা ক্রিয়া করেছিল ক্ষত্রিয়রা জগন্নাথের পূজা করবে। ব্রহ্মলোকে ধ্যানে মগ্ন ব্রহ্মার দ্বারা মন্দির শুদ্ধিকরণ ও উদ্বোধনের জন্য রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে নয় যুগ ব্রহ্ম লোকে অবস্থান করতে হয়েছিল।

বহু যুগ পর গালমাধব মন্দিরের সন্ধান পাওয়ায় ইন্দ্রদ্যুন্ন ও গাল মাধবের মধ্যে বাদানুবাদ সৃষ্টি হয়। মন্দিরের সত্য নিয়ে যখন দুই রাস্থার মধ্যে চরম অবস্থার সৃষ্টি হয় যুগ যুগান্তর ধরে সেখানে বসবাসকারী ভূসন্তীকাক ইন্দ্রদ্যুন্ন এর পক্ষে সাক্ষী প্রদান করে। ভবিষ্যতে মন্দিরের বিগ্রহ পূজায় যাতে ইন্দ্রদ্যুন্নের বংশধররা অভিশাপগ্রন্থ না হতে পারে তার ১৮ জন পুত্রকে হত্যা করেন। তাদের রক্তের দ্বারা থেকে ১৮ টি নালার সৃষ্টি হয় পুরীতে যেদিক দিয়ে যাওয়া হোক না কেন ১৮ টি নালা অবশ্যই পার হয়ে যেতে হবে। রথযাত্রা প্রতিবছর সূর্য গ্রহণের সময় শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীবলরাম ও সুভদ্রা তিনজন তিনখানা রথ নিয়ে কুরুক্ষেত্রে আসতেন। কৃষ্ণশুন্য বৃন্দাবনে রাধারানী, সখা-সখী ও গোপিগন বিরহ বেদনায় কাতর হয়ে পড়েছিলেন। সেই জন্য সবাই মিলে মনে মনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ যখন কুরুক্ষেত্রে আসবেন বৃন্দাবনের সবাই মিলে তাদের রথ বৃন্দাবনে নিয়ে আসবেন। সিদ্ধান্ত মোতাবেক শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীবলরাম ও সুভদ্রার রথ যখন কুরুক্ষেত্রে পৌঁছলেন। সঙ্গে সঙ্গে সখা-সখী, গোপ ও গোপিগণ মিলে ওই তিনখানা রথের রুজ্য ধরে টেনে-টেনে বৃন্দাবনের দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। উক্ত রথ টানাটানি থেকে রথযাত্রার উৎপত্তি। ভক্তদের রথ টানা বা শক্তি দিয়ে টানা হয় বলে নাম রথ টানা। মোট ৯ দিনে এই রথযাত্রা। এই রথের অন্য নাম পতিত পারন যাত্রা আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয় দিনরত যাত্রা শুরু হয় তাই ইহাকে রথ দ্বিতীয় বলা হয় আবার এই রথযাত্রাকে পাহন্তি বা পাড়ু বিজয় ও বলা হয়। শ্রী শ্রী জগন্নাথের মন্দির মাহাত্ম্যঃ স্বয়ং ব্রহ্মা দেব এই মন্দিরটি উৎসর্গ ও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিশ্বকর্মা এই মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের উচ্চতা ১৬২ ফুট নীলগিরি পর্বতের উপর তৈরি হয়েছে বলে ইহাকে নীলাচল বলে।

সমস্ত দেবতাগণ এখানে এসেছেন বলে পুরি বলা হয় এই শ্রীক্ষেত্রে সাক্ষাৎ ভগবান দারুময় রূপ ধরে বিরাজিত রয়েছেন। এই মন্দিরের চূড়ায় বিষ্ণু চক্রধারা সুশোভিত। এখানে মানুষ পশুপক্ষী কীটপতঙ্গ যে কোন জীব মৃত্যু হলে মুক্ত হয়ে যায়। জীবকূলের পৃথিবী বন্ধন বিমোচনের জন্য পুরুষোত্তম ক্ষেত্র অপেক্ষা আর কোন শ্রেষ্ঠতম ক্ষেত্র নাই। এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল উৎপলের রাজা গজপতি অঙ্গদ ভীম দেবের সময়। এই মন্দিরে কেহ কোন বিষয়ে প্রার্থনা করে বিফল হয়নি। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে জগন্নাথের ৫৬ বার ভোগ হয়, এই ভোগ প্রসাদ গ্রহণ করলে জগন্নাথ মন্দিরের সকল ফল পাওয়া যায়, মহা প্রসাদকে অবজ্ঞা করলে নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। শ্রী রথ যাত্রার মাহাত্ম্যঃ স্বয়ং ব্রহ্মা বলেছিলেন “রথঙ্কং বামনং দৃষ্ট পুনর্জন্ম না সিদ্ধতে” প্রবানে অর্থাৎ রথে অবস্থিত জগন্নাথকে দেখে তার আর পূর্ণজনন্ম হয় না। ১০৮ বার সিংহাসনে জগন্নাথ কে দর্শন করলে যে পূর্ণ লাভ হয় একবার মাত্র রথের শ্রী জগন্নাথ দেখলে অথবা ফিরতি রথের উপর জগন্নাথ কে দর্শন করলে সেই ফল লাভ হয়। ভবিষ্যৎ তোর পঙ্গুরআনে আমরা দেখতে পাই যে সব ব্যক্তি ব্যক্তি উৎসবের সময় জগন্নাথ রথের সভা বৃদ্ধি করে ভগবান জগন্নাথ তাদের অভিলাষিত বন্ধু প্রদান করেন। চন্দ্র সূর্য গ্রহ ও নক্ষত্র সমূহ জগন্নাথ ভক্তের বঞ্চিত ফল পূরণ করেন, এমনকি কৌতূহলবশত রথের উপরে শ্রী জগন্নাথ কে দর্শন করলে দেবগন লাভ হয়, রথযাত্রার সময় যদি কোন ভক্ত গান বাজনা ও নৃত্য করে সেই ব্যক্তি স্বর্গলোকের রাজা হয়ে ধরাধামে অবতীর্ণ হবেন, জয় শ্রী শ্রী জগন্নাথ

লেখক- চিকিৎসক ও প্রাবন্ধিক।