মঙ্গলবার, ৮ জুলাই ২০২৫, ২৪ আষাঢ় ১৪৩২
মঙ্গলবার, ৮ জুলাই ২০২৫, ২৪ আষাঢ় ১৪৩২

নাজিরারটেক শুটকি মহাল : নোনা ঘামের গন্ধে গড়া হারানো ঐতিহ্য

এম. আবদুল মান্নান

বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলজুড়ে যে কয়েকটি প্রাচীন পেশাজীবী জনপদের পরিচিতি এখনো ঠিকে আছে ইতিহাসের পাতায়, তার মধ্যে কক্সবাজার শহরতলীর ১নং ওয়ার্ডের সমিতিপাড়ায় অবস্থিত নাজিরাটেক শুটকি মহাল অন্যতম। এটি শুধু একটি শুটকি উৎপাদন কেন্দ্র নয়—এটি ছিল হাজারো জীবনের রোজগারের হাতিয়ার, শত বছরের ঐতিহ্য, আর লবণজলে ভিজে থাকা মানুষের ঘাম, গান আর কষ্টের দলিল।

বাঁকখালী নদীর মোহনায়, কক্সবাজারের নুনিয়ারছড়ার উত্তর-পশ্চিমে মহেশখালী আর সোনাদিয়ার মাঝামাঝি, বঙ্গোপসাগরের তটরেখায় গড়ে ওঠা এই শুটকি মহাল আজও দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। একসময় দক্ষিণ চট্টগ্রামের মাছ ধরার ট্রলারগুলো ভিড় করতো এই মহালের কাছেই—কক্সবাজার ফিশারিঘাট থেকে শুরু করে নাজিরাটেক পর্যন্ত প্রতিটি ঘাটজুড়ে চলত লেনদেন, দর কষাকষি, আর প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা বাজারের ধুমধাড়াক্কা।

নাজিরাটেক ছিল চট্টগ্রামের একমাত্র প্রধান শুটকি উৎপাদন কেন্দ্র। এখান থেকে শুটকি যেতো চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ, ঢাকার কারওয়ান বাজার, সিলেটের শাহী ঈদগাহ, এমনকি দেশের বাইরে পর্যন্ত। এক সময় এই এলাকার শুটকি ছিল আন্তর্জাতিক মানের পণ্য। এখানকার নামজাদা সওদাগররা ছিলেন এলাকায় পরিচিত ধনী ও দানশীল ব্যক্তি।

কিন্তু সময় বদলেছে। শুটকি মহালটি এখন সংকুচিত হয়ে এসেছে শতকরা অল্প ক’জনের হাতে। অকাল বৃষ্টি, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, কাঙ্ক্ষিত মৌসুমের অভাব, আর সমুদ্রের মাছের ঘাটতির কারণে অনেকেই একের পর এক লোকসানে ডুবে গেছেন। কারও কারও ঘরবাড়ি পর্যন্ত বিক্রি হয়ে গেছে। কেউ কেউ পেশা বদলেছেন, আবার কেউ নিঃস্ব হয়ে নিখোঁজ হয়েছেন সমাজের চোখ থেকে।

তবুও এখনও আছেন কিছু পরিবার, যারা বংশপরম্পরায় বয়ে আনা এই পেশাটিকে আঁকড়ে ধরে লড়ছেন। তাদের চোখে মুখে এখনো শত বছরের শিকড়ের টান, আর জীবনের অর্থ খুঁজে নেওয়ার নিরন্তর চেষ্টার ছাপ।

শুধু পুরুষ শ্রমিক নয়, এই শুটকি মহালে ছিল নারী শ্রমিক ও শিশু শ্রমিকদের বিশাল অংশগ্রহণ। জেলার লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থানের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই একটি অঞ্চল। এখানে সকাল হতো জালের টানাটানিতে, দুপুর গড়াত মাছ শুকানোর ব্যস্ততায়, আর সন্ধ্যা নামতো আঞ্চলিক গানের সুরে।

প্রতিটি ঝুপড়ি ঘরে, দোকানে বাজতো বিচ্ছেদ গান, বাউল আর ভাওয়াইয়া ক্যাসেট। আনন্দ-বিনোদন, বাংলামদ, সুখ-দুঃখের গল্প আর মজলিস—সব মিলিয়ে এটি ছিল এক নিজস্ব জগৎ। শুটকি মহাল ছিল যেমন জীবন-জীবিকার উৎস, তেমনি এক প্রকার সংস্কৃতির কেন্দ্রও।

তবে এই জনপদের সবচেয়ে বেদনাদায়ক এক অধ্যায় হলো বাল্যবিবাহ। কারণ এখানে আশ্রয় নিয়েছিলো বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা ভাসমান মানুষ এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কিছু অংশ। গৃহহীনতা আর অনিশ্চয়তায় জন্ম নিয়েছিলো অপ্রাপ্ত বয়সে বিবাহের প্রবণতা, যা দীর্ঘকাল সমাজকে ক্ষতবিক্ষত করেছে।

ভবিষ্যতের করণীয়
এই ঐতিহ্য ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় পেশাটিকে রক্ষা করতে হলে এখনই প্রয়োজন বিজ্ঞানভিত্তিক আধুনিক পদ্ধতিতে শুটকি উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণে দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ।
১। সরকার ও এনজিও সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগে—কম খরচে স্বাস্থ্যসম্মত শুটকি উৎপাদনের প্রযুক্তি ছড়িয়ে দেওয়া।
২। প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও মান নিয়ন্ত্রণ ল্যাব স্থাপন করা।
৩। স্বল্পসুদে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করা।
৪। রপ্তানিমুখী বাজার সৃষ্টি করা।
এই উদ্যোগগুলো গ্রহণ করলে শুটকি শিল্পের উন্নয়ন মানে শুধু ঐতিহ্য রক্ষা নয়—এটি অর্থনীতির গ্রামীণ চাকা সচল রাখাও। এই মহালকে সংরক্ষণ করা মানে শুধু মাছ শুকানোর একটি জায়গাকে বাঁচিয়ে রাখা নয়—এটি আমাদের প্রজন্মকে, শ্রমজীবী সংস্কৃতিকে, বঞ্চিতদের কণ্ঠস্বরকে বাঁচিয়ে রাখা।