হাসান মুকুল:
স্বাধীনতার মহান ঘোষক বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা শহীদ জিয়াউর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, এদেশের মাটি ও মানুষ আমাদের সংস্কৃতির উৎস, বাংলাদেশ আমাদের শেষ ঠিকানা। তাই তার সভা-সমাবেশে ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ’ গানের সাথে হাততালির মাধ্যমে তিনি অনুষ্ঠান শুরু করতেন।
জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালের ৩০শে মে চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একদল কর্মকর্তা কর্তৃক নিহত হন।মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন জিয়াউর রহমান । শুক্রবার মধ্যরাত পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন শেষে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসের ৪ নম্বর কক্ষে ঘুমে নিমজ্জিত। বাইরে মূষলধারে বজ্রবৃষ্টি। সে সময়ের একদল বিপদগামী সেনা কর্মকর্তা ষড়যন্ত্রকারীদের ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহার হয়ে এদেশের গণমানুষের নেতা জিয়াউর রহমানকে হত্যা করে।জিয়াউর রহমান কর্মজীবন শুরু করেন সৈনিক হিসেবে এবং তার জীবনাবসান হয় একজন সফল রাজনীতিবিদ ও গণমানুষের নেতা হিসেবে। ঢাকা মানিকমিয়া এভিনিউতে স্মরণকালের বৃহৎ নামাজে জানাজা তার প্রতি জনগণের ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ। জিয়ার রাজনৈতিক আদর্শের কর্মী-সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীদের উচিত জিয়াউর রহমানকে বুকে ধারণ করে সাধারণ মানুষের মধ্যে জিয়াউর রহমানের কর্মময় আদর্শ তুলে ধরা।
মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য বাংলাদেশ সরকার তখন তাকে বীর উত্তম উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে বর্বর সামরিক অভিযান চালিয়ে যখন নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালিকে নিমর্মভাবে হত্যা করছিল, তখনই মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তাঁর এমন ঘোষণা আকস্মিকভাবে হতবিহ্বল জাতিকে উজ্জীবিত এবং পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর নির্মম অত্যাচারে জর্জরিত জনমনে আশার সঞ্চার করে।মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ, বীর উত্তম তার লেখা ‘বাংলাদেশ অ্যাট ওয়ার’ গ্রন্থে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার কথা উল্লেখ করেন।
জিয়াউর রহমান নিজেও তাঁর স্বাধীনতার ঘোষণার প্রসঙ্গ ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর লেখা বার্থ অব অ্যা নেশন’ নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘২৫ মার্চ রাতে আমরা স্বাধীনতার জন্য বিদ্রোহ করি। তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেনাবাহিনীর একজন মেজর ছিলেন।মেজর জিয়া নিবন্ধে লিখেছেন, ‘যখন আমি ব্যাটালিয়নে ফিরে আসি তখন দেখি সব পাকিস্তানি অফিসারকে গ্রেফতার করে একটি ঘরে রাখা হয়েছে। আমি অফিসে যাই। আমি লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম আর চৌধুরী ও মেজর রফিকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি, কিন্তু পারিনি। পরে, বেসামরিক বিভাগের টেলিফোন অপারেটরকে ডেকে ডেপুটি কমিশনার, পুলিশ সুপার, কমিশনার, ডিআইজি এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের জানানোর অনুরোধ করি যে ৮ নম্বর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করেছে এবং তারা দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করবে।
জিয়া আরও লিখেছেন, ‘আমি টেলিফোনে সবার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাদের ধরতে পারিনি, তাই টেলিফোন অপারেটরের মাধ্যমে বার্তা পাঠানোর চেষ্টা করি। সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমি ব্যাটালিয়নের অফিসার, জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার এবং সৈন্যদের ডাকি। আমি তাদের উদ্দেশে ভাষণ দেই। তারা সবকিছু জানত। সংক্ষেপে আমি সবকিছু বলি এবং যুদ্ধের নির্দেশ দেই। তারা সবাই সর্বসম্মতভাবে আমার আদেশ পালন করতে রাজি হয়। আমি একটি সামরিক পরিকল্পনা তৈরি করি।
শফিউল্লাহ তার বইেয় লিখেন, ব্যাটালিয়ন শক্তিশালী হতে শুরু করলে, ২৭ মার্চ বিকেলে জিয়া কালুরঘাটে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আরেকটি ঘোষণা দেন। এই ঘোষণায় তিনি বলেন, ‘আমি, মেজর জিয়া, বাংলাদেশ মুক্তি বাহিনীর অস্থায়ী প্রধান সেনাপতি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।
বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে তার প্রতিবেদনে বলেছিলেন, ‘চট্টগ্রামে অস্ত্র হাতে লড়াইরত মেজর জিয়াউর রহমান আওয়ামী লীগ নেতাদের পরামর্শ অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের গণহত্যা বন্ধে সাহায্যের আবেদন জানান।
মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ বাহিনীর উপ-অধিনায়ক এবং পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকার তার বই ‘১৯৭১: ভেতরে বাইরে’-এ লিখেছেন, মেজর জিয়া তাঁর প্রথম ঘোষণায় নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে উপস্থাপন করেন। পরে তিনি এটি সংশোধন করে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। এটি টেপে রেকর্ড করা হয়। এটি ২৭ মার্চ সন্ধ্যার আগেই পুনঃপ্রচার করা হয়।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন থাকার সময় সংবিধান লঙ্ঘন, শেখ মুজিবের আত্মস্বীকৃত খুনিদের দেশত্যাগে সহায়তা এবং তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের অভিযোগে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) তার বীর উত্তম খেতাব বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়।
১৯৭১ সালে দেশে যখন রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হয় এবং পুরো জাতি দিশেহারা হয়ে পরে। এমতাবস্থায় মেজর জিয়াউর রহমান নিজ উদ্যোগে নিজের নামে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং পরবর্তীতে আরেকবার ঘোষণা সংশোধন করে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘোষণা দেন। মেজর জিয়াউর রহমানের কন্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা সকলকে অনুপ্রাণিত করে।মেজর জিয়াউর রহমান এর ঘোষণা অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছায় আর তিনি সামরিক অফিসার হবার কারণে ভিন্ন তাৎপর্য বহন করে বিশেষ করে বাঙালি সেনা, ই পি আর সেনা এবং পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের জন্য।
জিয়াউর রহমান জীবদ্দশায় জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট খন্দকার মোশতাক আহমদ কর্তৃক জারিকৃত সামরিক আইন প্রত্যাহার করেন। রাজনৈতিক দল ও রাজনীতি করার গণতান্ত্রিক ধারার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৭৮ সালে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিয়া প্রায় ৭৬% ভোট পেয়েছিলেন এবং জেনারেল ওসমানী কর্তৃপক্ষের ভাগ করা সংখ্যা অনুসারে ২১% ভোট পান। ওসমানীর সমর্থকরা দাবি করেছেন, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে এবং সারা দেশে ব্যালট বাক্স ভর্তির ঘটনা ঘটেছে। যাইহোক, ফলাফলের বিশ্লেষণে দেখা যায় যে নির্বাচনটি অনেকাংশে সুষ্ঠু হয়েছে এবং গোপালগঞ্জের মতো আওয়ামী লীগ অধ্যুষিত কয়েকটি জেলায় জিয়াউর রহমান মোট ভোটের ১৬% এর মতো কম পেয়েছেন।
১৯৭৭ সালের ২২ এপ্রিল সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের মূল-পরিবর্তন আনা হয়। মুসলিম লীগ ও জামায়াত-ই-ইসলামী সহ অন্যান্য দলগুলোর প্রত্যাবর্তনের সুবিধা প্রদানের পাশাপাশি তাদের সকল কার্যকলাপকে সাংবিধানিক বৈধতা দেওয়া হয়। এই সময় ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অনুমতিও প্রদান করা হয়। ১৯৭৮ সালের ৫ই এপ্রিল সংবিধানের ৫ম সংশোধনীতে বিশেষ ‘নাগরিকত্ব আইন’ প্রণীত হয়। যার আওতায় গোলাম আযমকে দেশে প্রবেশের অনুমতি ও ১৯৭৯ সালে আব্বাস আলী খানকে জামাতের আমীর হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বৈধতা প্রদান করা হয়।
১৯৭৭ সালের ৩০ এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও এদেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য ১৯ দফা যুগান্তকারী কর্মসূচি ঘোষণা করে দেশে ব্যাপক উন্নয়ন, খাল খনন, মৎস্য চাষ, শিল্প বিপ্লব, শিক্ষা বিপ্লব, কৃষি বিপ্লব ও বন্ধ কলকারখানা চালুর মাধ্যমে দেশকে আত্মনির্ভরশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে তলাবিহীন ঝুড়ির দেশের বদনাম ঘুচিয়ে স্বনির্ভর দেশে পরিণত করেন। তার আমলেই প্রথম বিদেশে চাল রপ্তানি করা হয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নতি, বিদেশি বিনিয়োগ, দেশে প্রথম গার্মেন্ট শিল্প ও ইপিজেড প্রতিষ্ঠা হয়। তিনি প্রতিবেশী দেশসহ সব দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোর সাথে বিশেষ সুসম্পর্ক, মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমবাজারে প্রবেশ তার বৈদেশিক নীতির অভূতপূর্ব সাফল্য। তিনি ছিলেন সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা। দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, গণমুখী শিক্ষাব্যবস্থা, যুব ও মহিলাদের কর্মসংস্থান, দেশে খেলাধুলার উন্নয়নে নতুন দিগন্তের সূচনা করেন। তিনি ছিলেন দেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ‘এদেশের মাটি ও মানুষ আমাদের সংস্কৃতির উৎস’, বাংলাদেশ আমাদের শেষ ঠিকানা। তাই তার সভা-সমাবেশে ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ’ গানের সাথে হাততালির মাধ্যমে তিনি অনুষ্ঠান শুরু করতেন। তার শাসন আমলে জাতীয় সংসদের উদ্বোধনী বক্তব্যে প্রেসিডেন্ট জিয়া জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামে অসামান্য অবদান রাখায় মহান নেতা শেরে বাংলা এ কে এম ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীসহ জাতীয় নেতাদের নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে বিশাল হৃদয়ের পরিচয় দিয়ে গেছেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে সব সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে ছিলেন। জনগণের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য মধ্য রাতে বের হয়ে যেতেন এবং চলার পথে হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে কোনো প্রটোকল না নিয়ে গ্রামের মেঠোপথে হাঁটা শুরু করতেন এবং বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে মানুষের সার্বিক অবস্থার খোঁজখবর নিতেন।
১৯৭৭ সালের ৩০ মে অনুষ্ঠিত গণভোটটি রাজনৈতিক ভাষ্যকার এবং পর্যবেক্ষকদের হতবাক করেছিল। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন অনুসারে জিয়া ৯৮.৮৭% ভোট পেয়েছিলেন, মাত্র ১% ভোটার তার মতামতের বিরোধিতা করে, প্রক্রিয়া সম্পর্কে গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল।গণভোটকে বিতর্কিত করার সাথে সাথে জিয়া পরের বছরে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ঘোষণা দেন। যেটি ছিল রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচন।জিয়া, একজন যুদ্ধ-নায়ক, জাতীয়বাদী ফ্রন্টের প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়েছিলেন, ছয়টি দলের জোট যার মধ্যে একদিকে মুসলিম লীগের মতো ইসলামপন্থী দলগুলি এবং অন্যদিকে তফসিলি জাতি ফেডারেশনের মতো সংখ্যালঘু-নেতৃত্বাধীন দলগুলি অন্তর্ভুক্ত ছিল। তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানী, যিনি আওয়ামী লীগ এবং কিছু বামপন্থী দলের একটি প্ল্যাটফর্ম গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট দ্বারা সমর্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ছিল জিয়ার রাজনৈতিক দর্শন। এ দর্শনের পটভূমি, যুগোপযোগী এবং লক্ষ্য সম্পর্কে উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি নিজে লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শন শত শত বর্ষ ধরে এদেশের আপামর জনগণের অন্তরে চির জাগরুক রয়েছে। যুগ যুগান্তরের দেশপ্রেমিকদের হৃদয়ের মর্মমূলে নিহিত তাদের সর্বোৎসাহ, উদ্যোগ ও প্রেরণার উৎস এই দর্শন। এই দর্শনে নিহিত রয়েছে বাস্তব আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক কর্মসূচি যা দেশের ঐক্যবদ্ধ জনগণকে সমকালীন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে উপযোগী, বাস্তবমুখী ও সময়োচিত শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়নে উদ্বুদ্ধ করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুসংবদ্ধ করবে, জাতিকে সুনিশ্চিতভাবে অগ্রগতির ও সমৃদ্ধির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেবে এবং বিশ্ব জাতির দরবারে বাংলাদেশকে মর্যাদা ও গুরুত্বের আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করবে।’ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মূল লক্ষ্য শনাক্ত করছেন তিনি এভাবে : ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে একটি শোষণমুক্ত সমাজ, যা অত্যন্ত বাস্তব ও প্রগতিশীল একটি সমাজ, যাতে থাকবে সমতা, নিরপেক্ষতা ও ন্যায়বিচার।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি কি, সঙ্গতকারণেই সে প্রশ্ন ওঠে। কি কি বিবেচনার ওপর এ দর্শন গড়ে উঠেছে সেটিও তিনি অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছেন। তার ভাষায়: “আমরা বলতে পারি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে মোটামুটি সাতটি মৌলিক বিবেচ্য বিষয় রয়েছে, যা হচ্ছে :
১. বাংলাদেশের ভূমি অর্থাৎ আন্তর্জাতিক সীমানার মধ্যবর্তী আমাদের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক এলাকা; ২. ধর্ম ও গোত্র নির্বিশেষে জনগণ; ৩. আমাদের ভাষা বাংলা ভাষা; ৪. আমাদের সাংস্কৃতিক, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, উদ্দীপনা ও আন্তরিকতার ধারক বাহক আমাদের নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতি; ৫. দু’শ বছর উপনিবেশ থাকার প্রেক্ষাপটে বিশেষ অর্থনৈতিক বিবেচনার বৈপ্লবিক দিক;
৬. আমাদের ধর্ম— প্রতিটি নারী ও পুরুষের অবাধে তাদের নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসন ও রীতিনীতি পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা;৭. সর্বোপরি আমাদের ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ, যার মধ্য দিয়ে আমাদের বাংলাদেশী জাতীয়তার দর্শন বাস্তব ও চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছে।
জিয়াউর রহমান তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা থেকেই জনকল্যাণ ও দেশ উন্নয়নে দিকনির্দেশক হিসাবে ১৯ দফা চালু করেন।
১. সর্বতোভাবে দেশের স্বাধীনতা, অখ-তা ও সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণ করা। ২. শাসনতন্ত্রের চারটি মূলনীতি অর্থাৎ সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি সর্বাত্মক বিশ্বাস ও আস্থা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের সমাজতন্ত্র জীবনের সর্বস্তরে প্রতিফলন করা।
৩. সর্ব উপায়ে নিজেদেরকে একটি আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসাবে গড়ে তোলা।
৪. প্রশাসনের সর্বস্তরে উন্নয়ন কার্যক্রম এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারে জনসাধারণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।৫. সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামীণ তথা জাতীয় অর্থনীতিকে জোরদার করা।
৬. দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা এবং কেউ যাতে ভুখা না থাকে তার ব্যবস্থা করা।৭. দেশের কাপড়ের উৎপাদন বাড়িয়ে সকলের জন্য অন্তত মোটা কাপড়ের সরবরাহ নিশ্চিত করা।৮. কোন নাগরিক যেন গৃহহীন না থাকে তার যথাসম্ভব ব্যবস্থা করা।৯. দেশকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করা।১০. সকল দেশবাসীর জন্য ন্যূনতম চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা।১১. সমাজে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা এবং যুব সমাজকে সুসংহত করে জাতি গঠনে উদ্বুদ্ধ করা।১২. দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেসরকারি খাতে প্রয়োজনীয় উৎসাহ দান।
১৩. শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি সাধন এবং উৎপাদন বৃদ্ধির স্বার্থে সুস্থ শ্রমিক মালিক সম্পর্ক গড়ে তোলা।১৪. সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে জনসেবা ও দেশ গঠনের মনোবৃত্তি উৎসাহিত করা এবং তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন করা।
১৫. জনসংখ্যা বিস্ফোরণ রোধ করা।১৬. সকল বিদেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সমতার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা এবং মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা।১৭. প্রশাসন ও উন্নয়ন ব্যবস্থা বেসরকারিকরণ এবং স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা।বর ১৮. দুর্নীতি ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা কায়েম করা।১৯. ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকল নাগরিকের অধিকার পূর্ণ সংরক্ষণ করা এবং জাতীয় ঐক্য সংহতি সুদঢ় করা।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, নিজ ধর্ম বিশ্বাসের প্রতি আস্থাশীল থাকলেও চিন্তা ও চেতনায় ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। তার শাসন আমলে এদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছিল অহংকার করার মতো। তিনি মসজিদ মাদ্রাসার পাশাপাশি মঠ-মন্দির, গির্জা প্রতিষ্ঠা করে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। জিয়া ধর্মীয় পরিচয়ে নয়, বাংলাদেশি হিসেবে সবার স্ব-স্ব ধর্ম পালনের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেন। তিনি প্রতিদিন ১৬-১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করতেন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থাকার পরেও অতি সাধারণের মতো জীবনযাপন করতেন। এমন কোনো শাখা বা বিভাগ নেই যেখানে তার হাতের স্পর্শ পড়েনি। কোনো ধরনের লোভ-লালসা তাকে স্পর্শ করতে পারে নি।
লেখক-
হাসান মুকুল
ব্যুরো প্রধান
দৈনিক দিনকাল,চট্টগ্রাম