বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব প্রবারণা পূর্ণিমা আজ। যথাযথ ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্যের সঙ্গে নানা আনুষ্ঠানিকতায় এ উৎসব উদযাপন করা হচ্ছে পার্বত্য জেলা রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে।
সোমবার (৬ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকেই রাঙামাটির প্রধান বৌদ্ধ ধর্মীয় উপাসনালয় রাজবন বিহারসহ, মৈত্রী বিহার, আনন্দ বিহার প্রায় সব বিহার পূণ্যার্থীদের উপস্থিতিতে মুখর হয়ে উঠেছে। খাগড়াছড়ির ধর্মপুর আর্যবন বিহার, গোলাবাড়ী আর্য অরণ্য ভাবনা কুঠির, য়ংড বৌদ্ধ বিহারসহ বিভিন্ন বৌদ্ধ বিহারে হয়েছে ফুল পূজা, বুদ্ধ পূজা।
ভক্তদের আনাগোনায় মুখরিত হয়ে উঠেছে রাঙামাটির রাজবন বিহার চত্বর। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের পাশাপাশি চলছে দান-ধ্যান ও বিশেষ প্রার্থনা। শিশু-কিশোরদের জন্য আজকের দিনটি বাড়তি আনন্দের, আর বড়দের জন্য দিনটি ভক্তি ও প্রার্থনায় মগ্ন হওয়ার সময়।
প্রতিবছর আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত বৌদ্ধ ভিক্ষুদের তিনমাস বর্ষাবাস অধিষ্ঠান শেষে হয় শুভ প্রবারণা উৎসব। এর পরপরই বিহারে বিহারে আয়োজন শুরু হয় দুই দিনব্যাপী কঠিন চীবর দানোৎসব।
রাজবন বিহারে ধর্মীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে উত্তোলন করা হয়েছে বুদ্ধ পতাকা। এরপর ভিক্ষু সংঘের প্রাতঃরাশ, বুদ্ধ পূজা, পিণ্ডদান, প্রবারণা পূরণ, বুদ্ধমূর্তি দান, সংঘ দান, অষ্টপরিষ্কার দান, হাজারবাতি দান, পঞ্চশীল প্রার্থনা, উৎসর্গ, সদ্ধর্ম দেশনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। অনুষ্ঠানে অগণিত পুণ্যার্থীর সমাগম ঘটেছে। এতে বিহারের আবাসিক প্রধান প্রজ্ঞালংকার মহাস্থবির ও রাজবন বিহারের জ্যেষ্ঠ ভিক্ষু জ্ঞানপ্রিয় মহাস্থবির ধর্মীয় দেশনা প্রদান করেছেন।
প্রবারণা পূর্ণিমা মূলত বৌদ্ধ ভিক্ষুদের তিন মাসব্যাপী বর্ষাবাস শেষে আত্মশুদ্ধি ও পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে পালন করা হয়। এই দিনে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা ভিক্ষুদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন, পূজা-অর্চনায় অংশ নেন এবং জীবজন্তুর কল্যাণ কামনায় প্রার্থনা করেন। অশুভ বিদায় ও মঙ্গল কামনার মধ্য দিয়ে মানুষ এই উৎসবে মেতে ওঠে।
পুণ্যার্থীরা বলেছেন, আজকের দিনটি আমাদের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আজকের দিনে ভিক্ষুরা তিন মাসের বর্ষাবাস শেষ করেন। আজকের দিনে আমরা পরিবার পরিজন ও সমগ্র জাতির মঙ্গল কামনা করে প্রার্থনা করি।
রাঙামাটি রাজবন বিহারের আবাসিক প্রধান শ্রীমৎ প্রজ্ঞালংকার মহাস্থবির বলেন, আজকের এই দিনে আমরা প্রার্থনা করি, সবাই যেন ধার্মিক, নীতিপরায়ণ ও ন্যায়নিষ্ঠ হয়। আমরা আশা করি, আমরা সকলেই যেন মিলেমিশে থাকতে পারি এবং পূণ্যময় কাজ করতে পারি।
খাগড়াছড়ি য়ংড বৌদ্ধবিহারে আসা ডা. সুজিতা চাকমা বলেন, মূলত আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত তিন মাস বৌদ্ধ ভিক্ষুরা নিজস্ব বৌদ্ধবিহারে অবস্থান করে নির্বাণ লাভের আশায় আত্মশুদ্ধির জন্য সংযম, ধ্যান করে থাকেন। তাদের এই ধ্যান পূর্ণতার জন্য বৌদ্ধ ধর্মের নর-নারীরা তাদের চীবর (ভান্তেদের পরিধানের কাপড়) পিণ্ড দানসহ নানাবিধ দান করেন। এই সময় সময়টা একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এর পরপর শুরু হয় মাসব্যাপী কঠিন চীবর দান উৎসব।
খাগড়াছড়ির সদরের দক্ষিণ খবং পুড়িয়া আদর্শ বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ নন্দপ্রিয় মহাস্থবির ভন্তে বলেছেন, তারা (বৌদ্ধ ভিক্ষুরা) মূলত বর্ষার সময়টাতে আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত নির্বাণ লাভের আশায় আত্মশুদ্ধির জন্য ধ্যান ও সংযম করেন। বিশেষ কোনো কারণ বা সংঘের অনুমতি ছাড়া নিজস্ব বৌদ্ধবিহারের বাইরে রাত্রি যাপন করেন না। এই সময়ে বৌদ্ধ ধর্মের নর-নারীরা তাদের বিশেষ যত্ন নেন। এর পর শুরু হয় তাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব কঠিন চীবর দান।
প্রবারণা পূর্ণিমা শুধু ধর্মীয় আচার নয়, এটি পাহাড়ের মানুষের মিলনমেলা ও সংস্কৃতির অনন্য রূপ। বছরের পর বছর ধরে প্রবারণা পূর্ণিমা পাহাড়ি জনপদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও আনন্দ-আলোকের প্রতীক হয়ে রয়েছে।